এক সময়ে মঞ্চ মাতানো ‘নায়ক’ এখন বিক্রি করেন মাটির হাঁড়ি!
মাসুমা জাহান,বরিশাল ব্যুরো:
যৌবনের শুরুতেই যোগ দেন সুগন্ধা অপেরায়।একে একে অর্ধশতাধিক যাত্রায় প্রধান চরিত্রে দর্শক মাতান।মানুষের মুখে মুখে সমাদৃত হন নায়ক সম্বোধনে।স্বল্প কোনো বয়সসীমা নয়,অধুনালুপ্ত বিনোদনের এই মাধ্যমে টানা ৪০ বছর যুক্ত ছিলেন।স্মৃতি রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও।কিন্তু কালের গর্ভে যাত্রার জমজমাট আয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় সেই সময়কার নায়কের জীবনে ভিলেন হয়ে দেখা দিয়েছে অভাব।
তাইতো জীবন সায়াহ্নে এসে কুমারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু মাটির তৈজসের বাজার ভালো না থাকায় সেখানেও টানাটানি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অভুক্ত থেকে যেন না মারা যান সেজন্য দেখা করতে চান বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে|
এক সময়ে মঞ্চ কাঁপানো এই নায়ক বাড়ির উঠানে নিজ হাতে তৈরি করা মাটির পাতিল রোদে দিতে দিতে কথা গুলো বলছিলেন|নাম তার কালিপদ পাল। বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি ইউনিয়নের পালপাড়ার শহীদ মধুসুধন পালের সন্তান তিনি।বয়সের ভারে ন্যুব্জ কালিপদ গুনে গুনে জানালেন ৮৫ বছর চলছে তার।পালপাড়ায় তার মত বয়স্ক কেউ নেই।বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে সকলের কাছে যেমন সম্মান পান,তেমনি তার নায়ক জীবনের গল্প নিয়ে এখনো আলোচনা হয় চায়ের টেবিলে,গ্রামবাসীর আড্ডায়।
তবে নিজে মধুময় সেই স্মৃতির কথা বলতে গেলে আড়ষ্ট হন,স্মৃতিভ্রমে আবেগ তাড়িত হন।এজন্য নায়ক জীবনের গল্প এড়িয়ে চলেন।
কালিপদ পাল এই প্রতিবেদককে বলেন,মেট্রিক পাস করার পরপরই অপেরায় যোগ দেই।অভিনেত্রী ও সুগন্ধা এই দুটি অপেরায় কাজ করেছি।তবে প্রথম কাজ শুরু করি সুগন্ধা অপেরায়।এর মধ্যে ১৯৬০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছি পঞ্চাশটিরও বেশি পালায়।
তিনি বলেন, তখন মানুষের বিনোদনের আর কোনো মাধ্যম ছিল না।মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকতো অপেরার।অপেরা আসবে এই সংবাদ পেলে ওই এলাকায় এক-দুই সপ্তাহ আগে জমজমাট হয়ে উঠতো।নতুন নতুন দোকান বসতো।হাজারো মানুষ আসতেন একটি শো দেখতে।
কালিপদ বলেন,ওই সময়ে টাকার মান ভালো ছিল। প্রত্যেক রাতে প্রদর্শনী করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পেতাম।আমিতো নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতাম।এই টাকাই ছিল অপেরা শিল্পীদের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক। সারাদিন মানুষ আসতো,কথা বলতো।মানুষ আমাকে মডেল মানতো।আমি রাজার হালে ছিলাম। মানুষ আমাকে বিশ্বাস করতো। কিন্তু এখন আর কিছু নেই আমার।আমি নিঃস্ব। তখন সিরাজউদ্দৌলা ছিলাম,এখন ভিখারি।
তিনি বলেন,যেসব পালায় অভিনয় করেছি তার সবগুলোর নাম স্মরণ করতে পারব না। তবে যেগুলো মনে আছে তার মধ্যে সাগর ভাষা, রূপবান, আলোমতি, আপান দুলাল, রক্তস্নান, হরিশচন্দ্র, দামেস্কের কারাগার, টিপু সুলতান, নবাব সিরাজউদ্দৌলাসহ আরও অনেক পালায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছি। এর মধ্যে যখন বয়স কম ছিল তখন রাজপুত্র, যখন মধ্যম বয়স তখন রাজা আর একটু বেশি বয়সে রাজার পিতার চরিত্রেও অভিনয় করেছি।
বর্ষীয়ান এই অভিনেতা বলেন, স্বাধীনতার আগে থেকেই আমরা শেখ সাহেবের (শেখ মুজিবুর রহমান) দল করতাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ সাহেব কলসকাঠীতে আসেন। বর্তমান কলসকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে মানে জমিদার বাড়ির ময়দানে জনসভা করেন। ওই জনসভার আয়োজনে আমি ছিলাম। তাছাড়া তিনি যখন আসেন তখন তার সঙ্গে হেঁটেছি, কথা বলেছি। আমি শেখ সাহেবের লোক হিসেবে হলেও অন্তত হাসিনার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সঙ্গে দেখা করতে চাই। বলতে চাই, আমি ভালো নেই। আমার এখন খাবার জোটে না। মাটির কাজ করে যা আয় হয় তাতে না খেয়েও থাকতে হয়।
কালিপদ পাল বলেন, যুদ্ধের বছর ৩০ বৈশাখ কলসকাঠি বাজারের হাটবার ছিল। ওইদিন মিলিটারি কলসকাঠী আক্রমণ করে। তারা প্রথমেই খালের এপার-ওপারের পালপাড়ায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। আগুনে পুড়িয়ে দেয় বাড়িঘর। প্রায় সাড়ে তিনশ মানুষকে ধরে নিয়ে খালপাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী আমার বাবাকেও গুলি করে হত্যা করে। আমাদের ঘর আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। নগদ টাকা-পয়সা আর স্বর্ণালংকার সব লুট করে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম আমরা অথচ ওই সময়ে যারা মিলিটারিদের গ্রাম চিনিয়ে নিয়ে এসেছিল, আমাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল তারা এখন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে সরকারের সকল সুযোগ-সুবিধা নেয়। তারা ভালো আছেন। ১৯৭১ সালে আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করার পরপরই আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই। এরপর আর কোনো দিন অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারিনি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছি উঠে দাঁড়াতে। কিন্তু আর পারিনি। ১৯৭৮ সালে যাত্রাপালা ছেড়ে দেই। তারপর থেকেই পাল পেশায় আছি।
স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুশীল পাল বলেন, পালপাড়ায় বয়স্ক মানুষ কালিপদ পাল। তার বাবাকে ১৯৭১ সালে পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এর আগে তারা সচ্ছল ছিলেন। তিনি বিভিন্ন এলাকায় অভিনয় করতেন। কিন্তু এখন মোটেই ভালো নেই। অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছেন।
মৃৎশিল্পী রূপক পাল বলেন, কালিপদ পাল এখন সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারেন না। বসে বসে যতটুকু পারেন ততটুকু মাটির কাজ করে সংসার চালান। তার আয়ে দুই বোন, তিন মেয়ে ও দুই ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে দুজনও খুব ভালো নেই। সরকারের উচিত বৃদ্ধ এই মানুষটিকে সহায়তা করা।
কলসকাঠি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু জাফর হাওলাদার বলেন,কালিপদ পাল বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে (বৃহত্তর বরিশাল) যাত্রায় অভিনয় করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তাকে সকলেই চেনেন। তার অভিনয় আমরা দেখিনি। তবে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি। তার বাবাকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। কালিপদ পাল অসহায় অবস্থায় রয়েছে এটি সত্য। তবে আমি তাকে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। তিনি ভাতা পান।