বুধবার, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শীতকাল -|- ২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
dailyamadernatunsangbad.com - news@dailyamadernatunsangbad.com - www.facebook.com/dailyamadernatunsangbad/

বেগম রোকেয়া: নারী জাগরণের এক অগ্রদূত-মোশারফ হোসাইন!

প্রকাশিত হয়েছে- শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২২

বেগম রোকেয়া: নারী জাগরণের এক অগ্রদূত-মোশারফ হোসাইন!

এস.এম অলিউল্লাহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

আজ রোকেয়া দিবস। আজ জানব এই মহিয়সি নারীর চিন্তা চেতনা নিয়ে। একটি জাতি, দেশ তথা বিশ্ব কখনোই স্বাবলম্বী হতে পারে না নারীকে হিসেবের খাতা থেকে বাদ দিয়ে। উন্নতির প্রথম সোপান হল একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করা।সম্প্রতি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে নারী পুরুষের বৈষম্য ও ভেদাভেদ নেই বললেই চলে। তারা নারীকে যথার্থ মূল্যায়ন করছেন।ভবিষ্যতে দেখা যাবে নারী আর পুরুষের কাজের ভেতরে কোন তফাৎ থাকবে না। তখনই একটি জাতি যাবে উন্নতির চরম শিখরে, দেশ পৌঁছাবে যথাযথ মর্যাদায়, বিশ্ব হবে স্বাবলম্বী। মনে রাখতে হবে একটি দেশ তথা বিশ্বের উন্নতি কামনায় কখনোই পুরুষকে কিংবা নারীকে বাদ দিয়ে করা যাবে না। এই চিন্তা গুলো আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে জন্মানো বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০ – ৯ ডিসেম্বর, ১৯৩২)।
উন্নয়নশীল আর আর স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে কুসংস্কারের বিপরীতে উন্নত দেশগুলো শিক্ষা নিয়েছে ইতিহাস থেকে, নারীপুরুষে সৃষ্টি করেনি বিভেদ। তাই তারা আজ শীর্ষে। স্বল্পোন্নত আর উন্নয়নশীল দেশের মানুষ আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে বিবেককে বিসর্জন দেয়। যার পরিণাম দারিদ্র্য। আমাদের দেশের মানুষ আজও অসুখ-বিসুখ হলে ঝাড় ফুঁক করে, পানিপড়া খায় এবং অপেক্ষায় থাকে নানা কেরামতির অলৌকিক শক্তি লাভের আশায়। একবার ভাবুনতো এইদেশ কতখানি কুসংস্কার পেরিয়ে সভ্যজগতের আলোতে পৌঁছেছে? সত্যি কথা বলতে কি, আমরা আজও পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া কিছু অযৌক্তিক বদ্ধমূল ধারণা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কখনোই নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারেননি। ভেবেছেন ভোগ্যবস্তু হিসেবে “সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র” হিসেবে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সমাজের মহিলাদের যে শোচনীয় অবস্থা ছিল, বেগম রোকেয়া তার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। কেবল স্ত্রীশিক্ষার তীব্র বিরোধিতা এবং কঠোর অবরোধ প্রথার নয়, সবকিছুতেই পুরুষের তুলনায় সমাজে মহিলাদের অধিকার কত কম ছিল, তার বিবরণ ও বিশ্লেষণ পাই তাঁর লেখা থেকে। সেই সঙ্গে লক্ষ্য করি তিনি মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য কীভাবে অন্তহীন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছেন। বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মেয়েরা অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে স্বাবলম্বী হতে না পারলে সত্যিকার অর্থে কখনোই স্বাধীন হতে পারবে না তারা। সে জন্যে তিনি তাদের অর্থনৈতিক ভূমিকার উপর খুব জোর দিয়েছেন। এখানটাতে তাঁর পূর্ববর্তী মহিলাদের সঙ্গে মিল নেই। রোকেয়ার আগের মহিলারা লেখাপড়া শিখে আরও ভাল স্ত্রী হবার প্রতি যতটা ঝোঁক দিয়েছেন, তাদের স্বাধীনতার দিকে ততটা নজর দেননি।

রোকেয়ার সঙ্গে আগেকার নারী প্রগতির পথিকৃৎদের আর একটি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তারা নারীদের উন্নতির কথা বললেও নারী এবং পুরুষের একেবারে সমান অধিকারের কথা বলেননি। বলেননি, স্বামী প্রভু নন, তাঁর জীবনসঙ্গী মাত্র।
বর্তমানে যাকে নারীবাদ বলা হয়, মূল কথাটা প্রোলেটারিয়েটদের মত নারীদের একটা নির্যাতিত এবং শোষিত শ্রেণী হিসেবে গণ্য করা। এই শতাব্দীর একেবারে গোড়াতে, তারমানে প্রায় এক শতাব্দী আগে লিখলেও তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, পুরুষরা কীভাবে কতগুলো সনাতন ভূমিকার সঙ্গে নারীদের শনাক্ত করে এবং অলৌকিকত্বের দোহাই দিয়ে ধর্মীয় বিধান রচনার মাধ্যমে নারীদের চিরকাল শোষণ করে এসেছেন।

বেগম রোকেয়ার মধ্যে সেই শোষিত শ্রেণী সচেতনতা লক্ষ্য করি। যতদুর জানি, তাঁর আগে অন্য কোন বাঙালি মহিলা এবং ভারতীয় মহিলা এমন স্পষ্ট করে এই শ্রেণী শোষণের কথা বলেননি। সে দিক দিয়ে বেগম রোকেয়াই প্রথম বাঙালি ফেমিনিষ্ট এবং সত্যি বলতে কি, তাঁর প্রায় এক শতাব্দী পরেও, তিনি যে সচেতনতার মাত্রা তাঁর রচনার মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন, বাঙালি মহিলারা তার থেকে বেশি দূরে এগিয়ে যেতে পারেননি।
১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম ছিল জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের। তিনি ছিলেন জমিদার। বেগম রোকেয়ার ছিলেন দুই ভাই ইবরাহিম সাবের ও খলিল সাবের। তিন বোনের মধ্যে করিমুন্নেসা (১৮৫৫-১৯২৬) বেগম রোকেয়া ও হোমায়রা। সময় ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর লেখা থেকেই তাঁর বাড়ির পরিবেশের কথা তুলে ধরছি-
আমাদের এ অরণ্যবেষ্টিত বাড়ীর তুলনা কোথায়? সাড়ে তিনশত বিঘা লাখেরাজ জমির মাঝখানে কেবল আমাদের এই সুবৃহৎ বাটি। বাড়ীর চতুর্দিকে ঘোর বন, তাহাতে বাঘ, শূকর, শৃগাল- সবই আছে। আমাদের এখানে ঘড়ি নাই, সেজন্য আমাদের কোন কাজ আটকায় না। প্রভাতে আমরা ঘুঘু ও খুকি ও খুকি, চোখ গেল, প্রভৃতি পাখীর আলাপে শয্যা ত্যাগ করি। সন্ধ্যাকালে শৃগালের ‘হুয়া হুয়া ক্যা হুয়া’ শব্দ শুনিয়া বুঝিতে পারি, মাগরিবের নামাজের সময় হইয়াছে। রাত্রিকালে কুরুয়া পাখীর কা-আক কা-আক-কু’ ডাক শুনিয়া বুঝিতে পারি, এখন রাত্রি তিনটা। আমাদের শৈশব জীবন পল্লীগ্রামের নিবিড় অরণ্যের পরম সুখে অতিবাহিত হইয়াছে।”

মুসলমান পরিবারের কোন মেয়ের পক্ষে তখন পর্দা ভেঙ্গে বিদ্যালয়ে যাবার প্রশ্ন ছিল অবান্তর। এই পর্দাপ্রথা কত কঠোর ছিল বেগম রোকেয়ার নিজের জবানি থেকেই তার পরিচয় পাওয়া যায়- বাড়িতে কোন স্বল্প পরিচিত মহিলা বেড়াতে এলেও, পাঁচ বছরের বেগম রোকেয়াকে পর্দা পড়তে হত। বাইরের মহিলারা বেড়াতে এলে ক’দিন প্রাণপণ প্রায় অনাহারে কখনো চিলেকোঠায়, কখনো সিঁিড়র নিচে, কখনো দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকেছেন তিনি। প্রায় সমবয়সী দু’বছরের হালিম কখনও যদি তাঁকে একটু দুধ এনে দিতেন, তাহলে সেটাই হত তাঁর একমাত্র পথ্য।

মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়ায় আর একটা মস্ত বড় বাধা ছিল এই যে, তখনো তাদের লেখাপড়ার কোন স্কুল ছিল না। বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় সে যুগের তুলনায় বেশ পরিণত বয়সে- ষোল বছরে। কিন্তু পাত্রটি ছিল বিলেত ফেরত এক অবাঙালি দোজবরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আপাতদৃষ্টিতে যতটা দুর্ভাগ্যজনক মনে হচ্ছে, বাস্তবে বিয়েটা বেগম রোকেয়ার জন্য তেমন শোচনীয় ছিল না বরং বিয়েই হঠাৎ বেগম রোকেয়াকে মুক্তি দেয় পৈতৃক পরিবারের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে। পরিবারে তাঁর সত্যিকার অর্থে কোন স্বাধীনতা ছিল না
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত