আজ ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
পটিয়া (চট্টগ্রাম) থেকে সেলিম চৌধুরী:- দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া- চন্দনাইশ উপজেলার পাহাড়ে উৎপাদিত পেয়ারা চাষে বদলে গেছে হাজার পরিবারের ভাগ্য। পেয়ারা চাষে ইতোমধ্যে অনেক পরিবার শূন্য থেকে পরিণত হয়েছে লাখপতিতে। চন্দনাইশ ও পটিয়া উপজেলার শত শত পাহাড়ে বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয় পেয়ারা। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এখানকার পেয়ারার চাহিদা রয়েছে দেশব্যাপী। এমনকি বিদেশেও রয়েছে এসব পেয়ারার চাহিদা। উপজেলার পটিয়ার কাঞ্চননগর এলাকায় সর্বাধিক পেয়ারা চাষ হওয়ায় এখানকার উৎপাদিত পেয়ারার নামকরণও হয়ে গেছে কাঞ্চন পেয়ারা হিসেবে। প্রতি মৌসুমে চন্দনাইশের পাহাড়ি অঞ্চলে কমপক্ষে দু’হাজার বাগানে পেয়ারা চাষ হয়। চলতি মৌসুমেই শত কোটি টাকার পেয়ারা বিক্রি হবে বলে বাগান মালিক ও শ্রমিকরা জানান। এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা সাইজে বড়, দেখতে সুন্দর, খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় সারাদেশে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ফলে উৎপাদিত পেয়ারা ফাঁড়িয়ারা দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসে ট্রাকে করে কিনে নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করে থাকে। তাছাড়া চাহিদার কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বর্তমানে অল্প সংখ্যক পেয়ারা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বলে জানান পেয়ারা চাষিরা। চলতি বছর চন্দনাইশ উপজেলায় পেয়ারা উৎপাদন অন্যান্য বছরের তুলনায় একটু কম হলেও পেয়ারার দাম পাওয়া যাচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি। সু-স্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরা প্রতি ডজন পেয়ারা বর্তমানে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে (প্রকারভেদে) ৫০ থেকে ১০০ টাকায়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন রওশনহাট, পটিয়ার কমল মুন্সির হাট ও বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় প্রতিদিন ভোরে বসে পেয়ারার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। লাল কাপড়ে মোড়ানো দুই পুটলি (এক ভার) পেয়ারা বর্তমানে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এখানকার পেয়ারা চাষিরা দলবেঁধে গভীর রাতে পেয়ারা সংগ্রহ করতে বাগানে চলে যান। ভোরের আলো ফুটতেই শত শত পেয়ারা চাষি কাঁধে করে পেয়ারার ভার নিয়ে ৮/১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সংলগ্ন অস্থায়ী বাজারে বিক্রি করতে। এখান থেকে ফাঁড়িয়ারা পেয়ারা কিনে ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে সরবরাহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এছাড়াও কাঞ্চননগর, কাঞ্চননগর রেলস্টেশন, খানহাট, গাছবাড়িয়া কলেজ গেইট, বাদামতল, বাগিচাহাট, দোহাজারীতেও বসে পেয়ারার বাজার। পেয়ারা বিক্রির নির্দিষ্ট কোন বাজার না থাকায় বাধ্য হয়ে পেয়ারা বিক্রেতারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে বসেই বিক্রি করে পেয়ারা। প্রতিদিন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যাতায়ত করার সময় দেখা যায়, চন্দনাইশের কাঞ্চননগর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত শত শত কিশোর ও যুবক পেয়ারা নিয়ে মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। মহাসড়কে কোন বিলাসবহুল গাড়ি থামলেই হাতে পেয়ারা নিয়ে দৌড়ে যায় গাড়ির কাছে। আর যাত্রীরাও লোভ সামলাতে না ফেরে স্বাচ্ছন্দে কিনে নেয় রসালো এই কাঞ্চন পেয়ারা।
পাশাপাশি এ অঞ্চলে উৎপাদিত বিপুল সংখ্যক পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় পেয়ারা কিনতে আসা পাইকাররা নিজেদের ইচ্ছেমতো দামে পেয়ারা কিনে নেয় বলে অভিযোগ পেয়ারা বিক্রেতাদের। কোন সময় চাষিরা পাইকারদের বেঁধে দেয়া দামে পেয়ারা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানালে সেদিন পেয়ারা নিয়ে চাষিদের পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। শুধুমাত্র সংরক্ষণের অভাবে বাধ্য হয়েই পাইকারদের বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি করতে হয় চাষিদের। এতে তাদের বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
পাহাড়ি এলাকা কাঞ্চননগর, সরোজমিনে ঘুরে এবং পেয়ারা বাগান মালিক মোহাম্মদ ইদ্রিস, মো: ওসমান আবু বক্কর, শামসু মেম্বার, আবুল হাশেম, আমিনুল ইসলাম, ফজল আহমদ, কামাল উদ্দীন ও মালেক মিয়াসহ বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়, এ অঞ্চলটি উর্বর পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় কোন ধরনের বিশেষ যত্ন ছাড়াই এখানে পেয়ারার প্রচুর উৎপাদন হয়। এখানকার পেয়ারা সু-স্বাদু ও পুষ্টিমান হওয়ায় সারাদেশে এর চাহিদাও বেশি। তারা আরো জানান, পেয়ারা উৎপাদন হওয়া এসব পাহাড় সরকারি হওয়ায় প্রতি বছর খাজনা দিয়ে পেয়ারা চাষ করতে হয়। খাজনা দিয়ে অনেক সময় পাহাড়গুলো বন্দোবস্তি নিতেও চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় বলে জানান চাষিরা। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদন হওয়া সরকারি এসব পাহাড়গুলো চাষিরা যাতে স্থায়ী বন্দোবস্ত পায় সে দাবি জানিয়েছেন পেয়ারা চাষিরা। তারা আরো জানান, পেয়ারা চাষের সাথে জড়িতদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সুদমুক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হলে এ অঞ্চলে শুধুমাত্র পেয়ারা চাষ করেই দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন তারা। এখানে উৎপাদিত পেয়ারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে রপ্তানি করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশে। সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা পাইকারীহারে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলেও মনে করেন পেয়ারা চাষের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
পেয়ারা চাষি মোহাম্মদ আবদুল জানান, এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য কটি আধুনিক হিমাগার না থাকায় প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার পেয়ারা। তাছাড়া ফাঁড়িয়াদের বেঁধে দেয়া দামে পেয়ারা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় চাষিরা। তাই পেয়ারা চাষিরা সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে একটি পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার অথবা পেয়ারা জুস কারখানা স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।
চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুম মোয়াজেম্মা বলেন, চন্দনাইশের পাহাড়ে বর্তমানে সাড়ে ১৮’শ পেয়ারা বাগান রয়েছে। এখানকার পেয়ারা চাষিরা তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করেই পেয়ারা চাষ করে থাকেন। কৃষি অফিস থেকে তেমন কোন পরামর্শ নিতে তারা আসেন না। তবে পেয়ারা চাষিদের প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক পেয়ারা চারা বিতরণ করা হয় কৃষি অফিস থেকে।