আজ ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মার্চ মাস শেষ হয়ে এলো। ২৬ মার্চ ছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। মূলত এদিনটিকেই আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কোনো দেশের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হলে একটা সুনির্দিষ্ট কাঠামো অপরিহার্য হয়ে পড়ে। পৃথিবীর সব দেশেই স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু আমাদের ইতিহাসটা একটু ভিন্ন রকম। স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে রক্তাক্ত ঘটনা খুব কম দেশেই ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাথা নত করার মতো নেতা ছিলেন না। ব্যক্তিজীবনে শত কষ্ট-বঞ্চনা সহ্য করেও বাঙালির অধিকার আদায়ে ছিলেন আপসহীন। তিনি গণতন্ত্রমনা একজন বিশ্বখ্যাত রাজনীতিক ছিলেন বলেই রাজনৈতিক শালীনতা বজায় রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক সহনশীল ও শালীনতাবোধকে দুর্বলতা ভেবে পাকিস্তানি জান্তা শাসকগোষ্ঠী নির্বিচারে বাঙালি নিধনযজ্ঞে আত্মনিয়োগ করলে ভয়াবহ জনযুদ্ধে রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধটি। যুদ্ধ শুরু করতে হলে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। আর তাই একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের কাঠামো তৈরি করে পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শত্রুদের হাতে ধরা দেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন তাকে গ্রেফতার করতে না পারলে পাকিস্তানি অবাঙালি সৈনিকরা নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালির প্রতি ভয়াবহ আক্রমণ চালাবেন। তাই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নির্ভয়ে পাকিস্তানিদের কাছে ধরা দিয়ে বীরত্বের পরিচয় দেন।
বাঙালি শোষিত হতে হতে নিঃশেষ হতে চলেছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট এ জাতিকে মুক্তির সংগ্রামে উজ্জীবিত করেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা শেখ মুজিবর রহমান। স্বাধীনতার ইতিহাস আমরা কমবেশি সবাই জানি। আজকের তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস থেকে কতটা শিক্ষা নিয়েছে, প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা এখনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নানাভাবে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আমরা জানি, দীর্ঘ ২০০ বছর ইংরেজ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও বাঙালি স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ধর্মীয় চেতনার আলোকে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলে সমস্যা আরো প্রখর হয়ে ওঠে। পাকিস্তান নামক দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালি-অধ্যুষিত অংশে অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী শাসনের নামে নির্যাতন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, ধর্মের নামে দেশে অরাজকতা শুরু হবে। ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালি মুসলিম হিন্দু ঐক্যবদ্ধ সামাজিক রীতিনীতি মেনে বসবাস করে আসছিল। অথচ পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে থাকে। তরুণ শেখ মুজিব এই সব কর্মকাণ্ডকে বাঙালির মধ্যে বিভাজননীতি মনে করেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই আমাদের ভাষার ওপর আঘাত হানে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের তীব্রতায় বাংলা ভাষাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাঙালি-অবাঙালি বৈষম্যনীতি থেকে শাকগোষ্ঠী সরে না আসায় আন্দোলন অব্যাহত থাকে অধিকার আদায়ের জন্যে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হলে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করলেও শাসকগোষ্ঠী জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে তালবাহানা শুরু করে। অধিবেশন ডাকার কথা বলে তা নাকচ করে দেয়। নানা অজুহাতে শাসনতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করে। এমনি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বাঙালি জাতিকে দিকনির্দেশনা দেন। কীভাবে দেশ স্বাধীন হবে। স্বাধীনতার রূপরেখা ৭ মার্চের ভাষণেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইতিহাস সাক্ষ্য হয়ে থাকে ৭ মার্চের ভাষণ। ২৫ মার্চের মধ্যরাতের কিছু আগেই সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয় বাঙালি জাতির ওপর। নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এ ইতিহাস আমরা সবাই জানি, বিশ্ববাসীও জানে।
রাজনৈতিক, আইনসংক্রান্ত, দার্শনিক, ধর্মীয়, শিল্প ও সাহিত্যবিষয়ক সবরকম বিকাশ নির্ভর করে অর্থনৈতিক বিকাশের ওপর। যদিও এমন নয় যে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিই একমাত্র কারণ এবং একমাত্র সক্রিয় এবং বাকি সবকিছুই তার পরোক্ষ ফল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যদি স্বাধীনতা অর্জিত না হতো, তবে আমরা কোনো ফলই ভোগ করতে পারতাম না। স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে যে ইতিহাস তৈরি হয়েছে, তার বাঁকে বাঁকে রয়েছে রক্তের দাগ। আজও সে দাগ মুছে যায়নি। আমরা রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনেও সক্ষম হয়েছি। যদি বঙ্গবন্ধু না জন্মাতেন, তবে আজও পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বিদেশি প্রভুদের ফুটফরমায়েশ শুনে জীবিকানির্বাহ করতে হতো। আজ আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্ববোধ করি। আমাদের ভাবমূর্তি আজ বিশ্বদরবারে সমুজ্জ্বল। কাজেই স্বাধীনতা ইতিহাসের সমুজ্জ্বল দিকটি আমাদের মোহিত করে। উদ্বুদ্ধ করে দেশপ্রেমে। শত ষড়যন্ত্র করেও স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের চেতনাকে রোধ করতে পারেনি। দেশের অগ্রযাত্রাকেও রোধ করতে পারবে না।
লেখক :রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য